সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নিয়তির কী পরিহাস! ভারতে বাংলাদেশিদের ‘মেহমান’ আর ভারতীয় নাগরিকদের ‘বাংলাদেশি’ বানিয়ে হেনস্তা



আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অভিবাসন সংকট এবং জাতীয় নিরাপত্তা—এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জটিল এবং মানবিক ইস্যুগুলোর একটি হয়ে উঠেছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ইস্যু। সম্প্রতি, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সালেহ উদ্দীন আহমেদের একটি মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলে:


> “নিয়তির কী পরিহাস! ভারতে আসল বাংলাদেশিদের ‘মেহমান’ বানিয়ে, ‘পুশ ব্যাকের’ জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিককে ‘বাংলাদেশি’ বলে হেনস্তা করা হচ্ছে। এই সব দরিদ্র লোকগুলোকে ভারত সরকার ব্যবহার করছে।


এই বক্তব্য নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। চলুন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি বিষয়টি।


ভারতে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বিতর্ক

ভারতের বহু রাজ্যে—বিশেষ করে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং দিল্লিতে—যেসব দরিদ্র মুসলিম ও বাঙালি হিন্দু বসবাস করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রজন্ম ধরে ভারতেই বসবাস করলেও, তাদের "বাংলাদেশি" বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।


ভারত সরকার একাধিকবার দাবি করেছে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে, এবং এর ফলে নিরাপত্তা ও জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে—এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন ভারতের দরিদ্র, সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।


NRC ও CAA: ভারতীয় নাগরিকদেরই ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে?

২০১৯ সালে ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) চালু হয়। উদ্দেশ্য ছিল "আসল ভারতীয়" ও "বিদেশি" শনাক্ত করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ফলে লাখ লাখ প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকই বিপাকে পড়েন, যাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল না।


আসামে NRC তালিকা থেকে বাদ পড়েছে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ। এদের অনেকেই মুসলিম, এবং তারা এখন "বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী" হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন, যদিও তাদের জন্ম এবং বংশপরম্পরা ভারতের মাটিতেই।


বাংলাদেশিদের 'মেহমান' বানানো—কেন?

ভারত সরকার কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত বাংলাদেশি অভিবাসীদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে—এমন অভিযোগ বহু মানবাধিকার সংগঠনের। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্ত এলাকা দিয়ে "নিরাপদভাবে" কিছু অভিবাসীকে আসতে দেওয়া, পরে তাদের আইনি নিরাপত্তা দেওয়া—এই কাজ গোপনে চালানো হচ্ছে বলে একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।


একইসঙ্গে, ভারতের ভেতরে যেসব দরিদ্র ও দলিত জনগণ আছে, তাদের হয়রানি করা হয় রাজনৈতিক শুদ্ধতার নামে। অথচ প্রকৃত অনুপ্রবেশকারীদের অনেকে হয় উচ্চপদস্থ নেতার পরিচিত বা প্রভাবশালী লোক।


‘পুশ ব্যাক’ নীতির নেপথ্যে রাজনীতি

‘পুশ ব্যাক’ বলতে বোঝায়, সীমান্তে ধরে ফেললেই ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো। কিন্তু এই নীতির ভুক্তভোগীদের অনেকে ভারতীয় নাগরিক। তাদেরকে মধ্যরাতে ট্রাকে করে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অথচ বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করে না।


এর ফলে এই নিরীহ মানুষগুলো রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ে থাকেন, মানবেতর জীবনযাপন করেন সীমান্তবর্তী এলাকায়।


মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার

সালেহ উদ্দীন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, “নিয়তির কী পরিহাস!”—বাংলাদেশিরা ‘মেহমান’ আর ভারতীয় দরিদ্ররা ‘অনুপ্রবেশকারী’। এই পরিস্থিতি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়ও বটে।


বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত সীমান্ত ইস্যুতে রাজনৈতিক নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ‘যুদ্ধের সরঞ্জাম’ বানিয়ে নয়, তাদের অধিকার রক্ষা করে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।


উপসংহার

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নাগরিক অধিকারও। কোনো ব্যক্তি শুধু গরিব বলে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ বলে ‘বিদেশি’ হয়ে যেতে পারে না। ভারত ও বাংলাদেশের উচিত বাস্তবতার নিরিখে একটি যৌথ, মানবিক ও বাস্তবসম্মত অভিবাসন নীতি গ্রহণ করা।


সূত্র:

সালেহ উদ্দীন আহমেদের ফেসবুক মন্তব্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, দ্য হিন্দু, বিবিসি বাংলা, আল জাজিরা প্রতিবেদন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চুক্তিভিত্তিক/অস্থায়ী কর্মীদের জন্য সংবিধানের প্রাসঙ্গিক ধারা:

  ধারা ২০(১)  রাষ্ট্র শ্রমকে মর্যাদা দেবে এবং উপযুক্ত পুরস্কার দানে নিশ্চিত করবে। এটি শ্রমের সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার কথা বলে, যা অস্থায়ী কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  ধারা ২৯(১)  প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ ও পদপ্রাপ্তি সকল নাগরিকের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত থাকবে। এটা চুক্তিভিত্তিক বা অস্থায়ী নিয়োগে যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলে। ধারা ২৯(৩)  এখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য করবে না, তবে কিছু ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে পারে (যেমন প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ইত্যাদি)। প্রশাসনিক নীতিমালা ও নির্দেশনা: বাংলাদেশে চুক্তিভিত্তিক বা অনিয়মিত কর্মচারীদের বিষয়ে মূলত বিভিন্ন প্রশাসনিক পরিপত্র (office order/circular) অনুসরণ করা হয়: ১. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ): চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা” অনুসারে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বা বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২. চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বৈধতা ও সীমাবদ্ধতা: নির্ধারিত মেয়াদে (সা...

পল্লী বিদ্যুৎ সংস্কারে নেই অগ্রগতি মাঠে অস্থিরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: পল্লী বিদ্যুৎ সংস্কারে অগ্রগতি নেই, মাঠ পর্যায়ে বাড়ছে অস্থিরতা। পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কার্যক্রমে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ এসোসিয়েশন (বাপবিএ)-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সরকারের লিখিত আশ্বাসের ভিত্তিতে চলমান আন্দোলন গত ৫ জুন ২০২৫ তারিখে স্থগিত করা হলেও গত দুই মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ১৭ জুন দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছিল — একটি REB-পিবিএস একীভূতকরণ অথবা কোম্পানি গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরির জন্য এবং অন্যটি মামলা প্রত্যাহার, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল, চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের নিয়মিতকরণ ও অন্যায় বদলির বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য। তবে বাস্তবে এসব বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন, আন্দোলনকালীন সময়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ৫ জন লাইনক্রুর বিষয়টি এখনও অনিষ্পন্ন রয়েছে। পাশাপাশি সাময়িক বরখাস্ত, বদলি ও সংযুক্তদের পদায়ন, চাক...

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পুনঃপর্যালোচনায় সরকারের সিদ্ধান্ত: অর্থ উপদেষ্টা

 বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে করা বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংক্রান্ত সব দেশি-বিদেশি চুক্তি পুনঃমূল্যায়ন করা হবে। ১৫ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “বিগত সরকারের সময়ে কিছু বিদ্যুৎ প্রকল্পে চুক্তি করা হয়েছে যেগুলোর শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যপূর্ণ। এসব চুক্তি যাচাইয়ের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে এবং আমরা সেই অনুযায়ী আইনগত সহায়তা নিয়ে কাজ করছি।” তিনি আরও বলেন, “সরকারি খাদ্য মজুত বর্তমানে সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে—বোরো ধান সবচেয়ে বেশি, এরপর আমন, এবং আউশ সবচেয়ে কম কেনা হয়।” এ সময় তিনি আরও জানান, আগামী ৫ আগস্ট ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’ উদ্বোধন করা হবে এবং এর নির্মাণ খরচ ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।